মোঃ আসলাম আলী আঙ্গুর চিরিরবন্দর ( দিনাজপুর ) প্রতিনিধি
ক্ষেতের ফসল রক্ষায় আদিকাল থেকে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছেন কৃষকেরা। এর মধ্যে কাকতাড়ুয়া অন্যতম। ফসল রক্ষায় মানুষের আকৃতি দিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় কাকতাড়ুয়া। এতে পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় ফসল, লাভবান হন কৃষক। এ পদ্ধতিতে পাখিও মারা যায় না, আবার পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পায়।
সরেজমিনে চিরিরবন্দর উপজেলার বিভিন্ন ফসলি মাঠ ঘুরে দেখা যায়, অনেক ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে ফসল পাহারা দিচ্ছে। খুব ভালো ভাবে খেয়াল না করলে পাখির মতো ভয় পেয়ে যাবে যে কেউ। কৃষির আধুনিক পদ্ধতির যুগে কৃষকরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে ফসল চাষাবাদ করে এবং রোগবালাই দমন করে। তবে কিছু কৃষক এখনো সেই সনাতন কাকতাড়ুয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসল রক্ষার জন্য।
কৃষকেরা জানান, সাধারণত পশু-পাখিকে ভয় দেখাতে ও ফসল রক্ষায় বাঁশ, খড়, পুরাতন জামা আর মাটির হাঁড়িতে কালি দিয়ে মুখের আদল বানিয়ে ক্ষেতের মধ্যে দাঁ করিয়ে রাখা হয় কাকতাড়ুয়া। যা দেখতে অনেকটা দু হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মতো। মাথার আকৃতি দিতে কেউ খড় ব্যাবহার করে। খরের ওপর কাপড় পেঁচিয়ে আবার কেউবা মাটির হাড়ি বসিয়ে হাড়িতে সাদা রঙ বা কয়লা দিয়ে চোখ মুখের ছবি একে দেয় যা দেখতে কিছুটা মানুষের প্রতিকৃতির মতো হয়। এরপর শরীর ঢাকতে পুরনো শার্ট বা গেঞ্জি পড়িয়ে ফসলের জমিতে দাঁড় করিয়ে রাখে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় অবিকল মানুষের মতো কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পশু প্রাণীরা একে মানুষ ভেবে বিভ্রান্ত হয়। বাতাসে দোল খায় বলে কাক, শালিক, চড়ুই, ঘুঘুসহ অন্যান্য পাখি মানুষ ভেবে ভয় পায়, আর ক্ষেতে আসে না। স্বাধীনতা পরবর্তী ৯০’র দশক পর্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার ছিল চোখে পরার মতো। কৃষি বিভাগের নতুন নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কার করার ফলে পরবর্তী সময়ে এই পদ্ধতিগুলো বিলুপ্ত হতে শুরু করে। তবে কিছু কৃষক এখনো কাকতাড়ুয়া পদ্ধতি ব্যবহার করে। এখনো তাদের বিশ্বাস এটি ব্যবহারে ফসলের জমিতে ফসল ভালো হয়। কারো নজর লাগে না এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যাগেও ফসল ভালো থাকে।
উপজেলার অমরপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক রবিন চন্দ্র রায় মন্ডল বলেন, ফসলের ক্ষেত যেন মানুষের নজর না লাগে এই জন্য কাকড়ুয়া দেও। ‘বীজ বোনার আগে ক্ষেতে হালচাষের পর মাটিতে থাকা পোঁকা-মাকড় খেতে বিভিন্ন ধরনের পাখি আসে। বীজ বোনা অথবা চারা লাগানোর পরে পাখিদের আনাগোনা আরও বাড়ে। তখন ক্ষেতে সকাল-বিকেল পাহারা দিতে হয়, তারপরেও পাখিদের ফেরানো যায় না। তাই মরিচের ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া দিয়েছি।’
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক একজন কৃষক জানান , ‘আমরা কৃষক মানুষ, ক্ষেত-খামারে ফসল ফলিয়ে খাই। অনেক জমি চাষ করা লাগে। সব সময় তো আর পাখি তাড়াইেতে পারি না। তাই বাঁশ, খেড়, পুরাতন কাপড় আর মাটির হাঁড়ি দিয়া কাকতাড়ুয়া বানায়ে ক্ষেতে খাড়া করে রাখি। এতে আগের চাইতে পাখি কম আসে।’
ফসল রক্ষায় কাকতাড়ুয়ার উপকারিতা জানিয়ে একজন কৃষক বলেন, ‘কাকতাড়ুয়ার কারণে ক্ষেতে পাখি কম আসে। ফসলও নষ্ট হয় না। আমাদের বন্ধুর মতো করে সাহায্য করে। কাকতাড়ুয়া না দিলে মাঠে পাখি বসে সকাল-বিকেল। এতে করে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়।’ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করে ফসলের জমিতে ইঁদুর দমনে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়াও নিশাচর প্রাণীরা জমিতে বিচরণ করার সময় ভয় পায় ফসলেরও সুরক্ষা হয়।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা শারমিন সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এক সময় গ্রামের মানুষের মাঝে সচেতনতার অভাব ছিল। নানা কুসংস্কার এবং প্রথার প্রচলন ছিল। এত আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ছিল না, তাই কৃষকরা ফসল ফলাতে পূর্ব পুরুষদের দেখানো চাষ পদ্ধতি ব্যাবহার করত। এখন বিজ্ঞানের যুগ সবকিছুই আধুনিকায়ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কৃষির উন্নয়নে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তবে কতাড়ুয়ার মতো সনাতন পদ্ধতিগুলো এখনো কোনো কোনো কৃষক ব্যবহার করেন।
পাখি তাড়ানোর জন্য আদিকাল থেকে গ্রামের কৃষকরা ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া ব্যবহার করে আসছে। কৃষকেরা এখনো মনে করে কাকতাড়ুয়া ফসলি জমিতে দিলে মাঠের ফসল রক্ষা পায় এটা তাদের ধারনা ।